দীপন হত্যায় ৮ আসামীর ফাঁসির রায়


দীপন হত্যায় ৮ আসামীর ফাঁসির রায়

জাগৃতি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী, ব্লগার ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৮ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আজ বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন।

মামলায় অভিযুক্ত ৮ আসামির মধ্যে দুইজন পলাতক। বাকিরা কারাগারে আছেন। রায়ের আগে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামি হলেন- মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির, আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল রিফাত, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। এদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পালিয়ে আছেন।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে খুন হন ফয়সাল আরেফিন দীপন। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে একই ধরণের আরেকটি হামলায় নিহত দীপনের বন্ধু, লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের কয়েকটি বইয়ের তিনি প্রকাশক ছিলেন তিনি।

আনসার আর ইসলাম বাংলাদেশ নামে কট্টর ইসলামপন্থী একটি সংগঠন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে।

দীপনকে হত্যার পরই তার ডা. স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় মামলা করেন। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-ডিবি। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়।

জঙ্গিদের জবানবন্দি

দীপন হত্যার দায় স্বীকার করে আসামি মোজাম্মেল হুসাইন তার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করেছেন। ২০১৪ সালে সিলেটের আবু বকরের মাধ্যমে তিনি জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন। আর ওই বছর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে তাঁর সিলেটের টিলাগড়া এলাকায় পরিচয় হয়। জিয়া ছিলেন তাঁর মূল প্রশিক্ষক। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া দীপনকে হত্যার নির্দেশ দেন।

আসামি মইনুল হাসান শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ২০১০ সালে রাফি নামের হিযবুত তাহ্রীরের এক সদস্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি যখন সিলেটের মদনমোহন ডিগ্রি কলেজে পড়তেন, তখন রাফি তাঁকে জিহাদের কথা বলেন। তিনি ঢাকায় সেলিম ওরফে হাদীর কাছে পিস্তল চালানো শেখেন। দীপনকে খুন করার আগে তিনি নিজে আজিজ সুপার মার্কেট ও এর আশপাশের এলাকা রেকি করে আসেন। দীপনকে হত্যা করার পর সামরিক শাখার এক সদস্য প্রটেক্টেড টেক্সটে খুদে বার্তা পাঠান। এই খুনের মূল হোতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শেখ আবদুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি তাঁর বন্ধু আকিব বিন শাহরিয়ারের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন। পরে তাঁর সঙ্গে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার পরিচয় হয়। সংগঠনের কাজে তিনি প্রতি মাসে চট্টগ্রাম থেকে দুই/তিন লাখ টাকা আনতেন।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খাইরুল ইসলাম বলেন, তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়তেন। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। দীপনকে খুন করার আগে আজিজ সুপার মার্কেট এলাকায় রেকি করে আসেন। 

আদালতের পর্যবেক্ষণ:

এই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, জিহাদের অংশ হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসার উল্লা বাংলা টিমের সদস্যদের যারা এই মামলার আসামী তাদের লক্ষ্য ছিল, ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া।

এছাড়া মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করাও তাদের লক্ষ্য ছিল বলে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন।

আসামীপক্ষের প্রতিক্রিয়া:

এই রায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আসামীপক্ষের আইনজীবী এম এ বি এম খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, আসামিরা ন্যায়বিচার পায়নি, তাই রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা।

ফয়সল আরেফিন দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে। নিহত দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে দ্রততম সময়ে রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।